শেয়ার বাজারে টাকা লাগিয়ে সর্বশান্ত হয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা ভারত তথা গোটা বিশ্বে কম নয়। আবার উল্টোটাও সত্যি অর্থাৎ ঠিকঠাক শেয়ার কিনে অনেক মানুষই কোটিপতি হয়েছেন। সবটাই কি ভাগ্য? নাকি এর পেছনে আছে অন্য কোনো কারণ? আসুন সহজ বাংলায় জেনে নিই কি সেই সাধারণ ভুল যার ফলে মানুষ তার কষ্টর্জিত টাকা নিমেষে হারিয়ে ফেলে।
১) বন্ধু বা পরিচিত কারোর কথায় শেয়ার কেনা:
হয়তো আপনার কোনো বন্ধু বললো সে বাজাজ ফাইন্যান্স এর শেয়ার কিনে অনেক লাভবান হয়েছে তাই আপনার উচিত এই ফান্ডে ইনভেস্ট করা। আপনি আপনার বন্ধুর ওপর অগাধ বিশ্বাস রাখেন তাই চোখ বন্ধ করে উক্ত কোম্পানির শেয়ার কিনে ফেললেন। এখানে উদাহরণ দেওয়ার খাতিরে বাজাজ ফাইন্যান্সের কথা বলা হয়েছে। ধরা যাক আপনি শেয়ার কেনার পরই উক্ত কোম্পানির শেয়ার এর দাম পড়তে শুরু করলো। এক্ষেত্রে আপনি শেয়ার বাজারের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলবেন। তাই কোন বন্ধু, আত্মীয় বা সহকর্মীর কথা বা তাদের দেখাদেখি কোন শেয়ার কিনবেন না। যে কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে চাইছেন সেই কোম্পানি সম্পর্কে যাচাই করে নিন।
২) রিসার্চ এবং জ্ঞানের অভাব:
এখানে রিসার্চ বলতে কোনো জটিল বিষয়ের কথা বলা হয় নি। এখানে রিসার্চ বলতে শেয়ার বাজার কিভাবে কাজ করে সেসম্পর্কে পড়াশুনোর অভাবের কথা বলা হয়েছে। পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকানে বসে খবরের কাগজ সম্পর্কে আলোচনা করতে করতে শেয়ার বাজারের হালহকিকত জানা আর পড়াশুনোর মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। আজকাল ইন্টারনেটের সুবাদে অনেক অনলাইন আর্টিকেলের মাধ্যমে কারোর সাহায্য ছাড়াই আপনি এইসব বিষয়ে পড়াশুনো করতে পারেন এবং নিজের জন্য সঠিক শেয়ার পছন্দ করতে পারেন।
৩)রাতারাতি বড়োলোক হওয়ার লোভ:
কম সময়ে আপনার টাকাকে দ্বিগুন বা তিনগুন করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি অনেক কোম্পানি দেবে। কিন্তু কোম্পানির পেছনের ইতিহাস না জেনেই রাতারাতি বড়োলোক হবার লোভে অনেকেই দুর্বল শেয়ার এ নিজেদের সমস্ত পুঁজি ঢেলে দেওয়ার মত মারাত্মক ভুল করে।
৪) ধৈয্যের অভাব:
বিনিয়োগ দীর্ঘ সময়ের জন্য না করলে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। এমন অনেক মানুষ আছেন যারা যখন মার্কেট নিম্নমুখী হয় তখন নার্ভাস হয়ে পড়েন এবং টিকে থাকার ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। ফলে তড়িঘড়ি করে নিজের শেয়ার বিক্রি করে দেন। মনে রাখতে হবে যত বেশি সময়ের জন্য আপনি লগ্নি করে রাখতে পারবেন তত বেশি পরিমান রিটার্ন পাবেন। একটি চারাগাছ বৃক্ষে পরিণত হতে যেমন সময় নেয় ঠিক তেমনি আপনার অর্থকে বৃদ্ধি করতে দিতে হবে সময়।
৫) Penny স্টকে ইনভেস্ট:
পেনি স্টক বলতে সেই সব ভারতীয় কোম্পানির শেয়ার কে বোঝায় যাদের মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন ৫০০০ কোটির নিচে। এদের একটি ইউনিটের দাম পঞ্চাশ টাকার কম হয়ে থাকে। কম টাকায় অনেক বেশি ইউনিট কেনা যাবে এই নেশায় অনেকেই কোম্পানি সম্পর্কে না জেনে পেনি স্টকে ইনভেস্ট করেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে পেনি স্টক অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। অর্থাৎ আপনি হয়তো লাভবান হতে পারেন কিংবা সমস্ত পুঁজি হারাতে পারেন। আবার এই স্টকের লিকুইডিটিও কম অর্থাৎ হঠাৎ করে প্রয়োজন পড়লে আপনার স্টক বিক্রি করতে পারবেন না। তাই কম দামের শেয়ার এর প্রতি আকর্ষিত না হয়ে কোম্পানির ভ্যালুয়েশনের দিকে নজর দিন।
৬) মার্কেট ভ্যালু সম্পর্কে অজ্ঞতা:
একটি কোম্পানির মার্কেট ভ্যালু কত তা দেখে সেই কোম্পানির গ্রোথ এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে আন্দাজ করা যায়। তাই স্টকের কোয়ান্টিটির থেকে কোয়ালিটির দিকে ফোকাস রাখুন। যেমন রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ, টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস, এইচডিএফসি ব্যাঙ্ক, হিন্দুস্তান ইউনিলিভার, আইটিসি লিমিটেড ইত্যাদি কোম্পানি গুলি অতীতে বরাবর ভালো রিটার্ন দিয়েছে, আবার আগামীদিনে ভালো রিটার্ন পাওয়ার সম্ভবনা আছে তাই এগুলির একটি ইউনিটের দাম তুলনামূলক বেশি মনে হলেও এগুলিকে কোয়ালিটি স্টক বলে ধরা হয়।
৭) স্টক মার্কেটকে লটারির সাথে গুলিয়ে ফেলা:
যুগের পর যুগ ধরে লটারি খেলা জনপ্রিয় হয়ে এসেছে কারণ হল লটারি জেতার মধ্যে যে রোমাঞ্চ রয়েছে তা অল্প অল্প করে টাকা জমানোর মধ্যে নেই । কিন্তু স্টক মার্কেট কোন রোমাঞ্চকর জায়গা নয় , এখানে এক্সপেরিমেন্ট করতে গেলেই ঝুঁকি হাজার গুনে বেড়ে যায়।
৮) সংযমের অভাব:
মনে রাখবেন বিশ্বের অন্যতম সফল বিনিয়োগকারী ওয়ারেন বাফেট তার সম্পত্তি একদিনে গড়ে তোলেন নি। মাত্র দশ বছর বয়স থেকে শুরু করে এখনো পর্যন্ত তিনি বিনিয়োগ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে ৬৬ বছর বয়সে তার মোট সম্পত্তি ১০০ বিলিয়ন ডলারের ঊর্ধ্বে। তিনি যদি সংযমী এবং নিয়মনিষ্ঠ না হতেন তাহলে কি এই বিশাল পরিমান সম্পত্তি গড়ে তুলতে পারতেন? কম রোজগার করেও সংযমের সাথে নিয়মিত ভাবে দীর্ঘ সময় ধরে অল্প অল্প টাকা বিনিয়োগ করে ধনী হয়েছে এমন উদাহরণের অভাব নেই।
৯) সঠিক পরিকল্পনার অভাব:
কোনো রকম পরিকল্পনা ছাড়াই অনেকে নিজেদের সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ একটি স্টকে বিনিয়োগ করে বসেন। এটি মস্ত বড় ভুল। নিজের টাকাকে বিভিন্ন জায়গায় বন্টন করুন অর্থাৎ সবটাকা একটি ফান্ডে লাগাবেন না, স্টক, বন্ড, রিয়েল এস্টেট, গোল্ড ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিভাজিত করে রাখুন যাতে করে কোন একটি বা দুটিতে লোকসান হলেও বাকিগুলো দিয়ে ভারসাম্য বজায় থাকে।
১০) ডে ট্রেডিং করা:
ডে ট্রেডিং হলো দিনের দিন বেচাকেনা অর্থাৎ সবচেয়ে কম সময়ের জন্য বিনিয়োগ। এটি সফল ভাবে করা সবার দ্বারা সম্ভব না। বাজারের ওঠা নামা সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান না থাকলে ডে ট্রেডিং করে মুনাফা অর্জন করতে পারবেন না, বরং চরম ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন। বিস্তারিত জ্ঞান, স্ট্রাটেজি তৈরী, নিয়মিত অনুশীলন এবং বাজার পর্যালোচনা ছাড়া ডে ট্রেডিং এ অংশগ্রহণ করা একটি মস্ত বড় ভুল।
তাই উপরের ভুলগুলি এড়িয়ে চলুন। শেয়ার বাজারে লাভবান হতে গেলে কচ্ছপের গতিতে চলাই শ্রেয়।