বইটির প্রতিটি অধ্যায়ে লেখক নেপোলিয়ন হিল টাকা উপার্জন করার গোপন রহস্য গুলি ভেদ করার চেষ্টা করেছেন। পাঁচশোরও বেশি ধনী ব্যাক্তির জীবনকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন নেপোলিয়ন হিল। এইসব ফর্মুলা গুলিকে বহু ব্যাক্তিত্বের উপর পরীক্ষা করেছেন এবং চমকপ্রদ ফল পেয়েছেন। লেখক মনে করেন তারাই সেইসব রহস্য ভেদ করতে পারেন যারা ”প্রস্তুত এবং এটির জন্য অনুসন্ধান করেছেন “।

বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩৭ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রেসিডেন্ট Woodrow Wilson এই ফর্মুলাকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেন। তারপর এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকটি সৈনিকদের উপর প্রয়োগ করেন। লেখক মনে করেন অর্থ, পরিচিতি এবং আনন্দ তারাই উপভোগ এবং উপলব্ধি করতে পারবেন যারা প্রস্তুত থাকবেন।

লেখক প্রথমেই একজন মানুষের গল্প বলেছেন তিনি হলেন Edwin C. Barnes যার মধ্যে এক জ্বলন্ত ইচ্ছে ছিল যে তিনি বিখ্যাত আবিষ্কর্তা Thomas A. Edison এর সাথে কাজ করবেন। কিন্তু তার শুধু ইচ্ছেটাই প্রবল ছিল, না তিনি এডিসনকে ব্যাক্তিগত ভাবে চিনতেন , না তার কাছে তার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার মতো যথেষ্ট টাকা ছিল। কিন্তু যুবক Barnes কোনোভাবেই হাল ছাড়ার পাত্র নন। তিনি শেষ পর্যন্ত সমস্ত বাধা অতিক্রম করে এডিসন এর মুখোমুখি দাঁড়ান। এডিসন এর সাথে কাজ করার যে ইচ্ছে শক্তি তার চোখে মুখে প্রকট ছিল সেটা এডিসনকে মুগ্ধ করে।

সেদিন এডিসনের ল্যাবরেটরিতে দাঁড়িয়ে Barnes কি বলেছিলেন সেটা বড়ো কথা নয়। এডিসনের সহকারী হওয়ার যে প্রবল ইচ্ছে সেটাই তাকে সফল করেছিল। যদিও প্রথম ইন্টারভিউতে তিনি তার ইচ্ছেমতো কাজটি পাননি তবে তাকে যে কাজ টি করতে দেওয়া হয়েছিল তিনি তাই করতে রাজী হন এবং এডিসনের business partner হওয়ার প্রবল ইচ্ছে তাকে তার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় কারণ “তিনি যা খুঁজছিলেন তা না পাওয়া পর্যন্ত তিনি প্রস্তুত থাকতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন” ।

এইভাবে কিছু মাস চলতে থাকে, এরপর এডিসন একদিন “ডিকটেশন” মেশিন তৈরী করলেন কিন্তু কোনো ব্যক্তি সেটি বিক্রি করার আগ্রহ দেখালেন না কিন্তু যুবক ব্যারনেস সেটিতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন এবং সেটিকে বিক্রি করতে সফল হলেন। এই আগ্রহ এবং ইচ্ছে দেখে এডিসন খুব খুশি হয়ে গোটা দেশে তার প্রোডাক্ট মার্কেটিং এবং ড্রিস্টিবিউশন করার দায়িত্ব দিলেন ব্যারনেস কে। শুরু হয়ে গেলো এডিসন এবং ব্যারনেস এর পার্টনারশিপ বিসনেস। তাদের এই জুটি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল গোটা দেশে যে একটি স্লোগান তৈরী করা হয় “Made by Edison and Installed by Barnes ” । এইসব যা সাধারণ মানুষের জন্য অসম্ভব ছিল তা “দৃঢ় ইচ্ছা” দ্বারা সম্ভব হয়েছিল।

সফল হওয়ার প্রথম ধাপ :

ট্রেনে ওঠার পয়সা না থাকায় ব্যারনেস মালবাহী ট্রেনে উঠে বসে এবং যখন সে ট্রেন থেকে নামে তাকে ধুলোমাখা এক ভোগঘুরে মনে হলেও তার চিন্তাভাবনা ছিল রাজার মত। এডিসন এর সাথে কাজ করার জন্য সে ছিল নির্ধারিত। তার জীবনটা এই একটা স্বপ্নের দ্বারা মোড়া ছিল এবং তার জ্বলন্ত ইচ্ছা এবং চিন্তাশক্তি বাস্তবের রূপ নেয়। Barnes সফল হয়েছিল কারণ তার সমস্ত কাজ ইচ্ছা চিন্তাশক্তি একমাত্র লক্ষ্যের দিকে নির্ধারিত ছিল। তাই পাঁচবছর তপস্যার পর তিনি তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছিলেন।

নেপোলিয়ান হিল ছয়টি প্রাকটিক্যাল ধাপের কথা বলেছেন যার মাধ্যমে ধনী হওয়ার আকাঙ্খাকেবাস্তব রূপ দেওয়া যায় :

১) মনের মধ্যে নির্ধারিত করুন ঠিক কত পরিমান টাকা চান। “আমি অনেক টাকা চাই এটা বলা যথেষ্ট নয় “। টাকার অংক আপনাকে সঠিক ভাবে ভাবতে হবে।

২) এবার নির্ধারণ করুন আপনার যে পরিমান টাকা চাই তার পরিবর্তে আপনি কি দিতে প্রস্তুত আছেন। কারণ যেকোন কিছুর একটি মূল্য আছে। বিনামূল্যে এই পৃথিবীতে কিছু পাওয়া যায়না।

৩) একটি নির্দিষ্ট তারিখ ঠিক করুন যেদিন আপনি আপনার টাকার লক্ষ্য অর্জন করতে চান।

৪) একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাছুন যার মাধ্যমে আপনার ইচ্ছাকে বাস্তব রূপ দেওয়া যায় এবং সেই কাজে লেগে পড়ুন।

৫) আপনি কত পরিমান টাকার মালিক হতে চান এবং কত বছর পর হতে চান , তার জন্য আপনি কি মূল্য দিতে প্রস্তুত আছেন এবং কি পরিকল্পনা করেছেন সমস্ত কিছু’পরিষ্কার ভাবে লিখে রাখুন।

৬) আপনার লিখিত স্টেটমেন্ট দিনে দুবার করে পড়ুন জোরে পড়ুন ,একবার রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে আর একবার সকালে ঘুম থেকে উঠে। যখন পড়বেন তখন অনুভব করতে চেষ্টা করবেন যেন বাস্তবে আপনি আপনার কাঙ্খিত অর্থের অধিকারী।

এই ছয়টি ধাপের সফল প্রয়োগ করার জন্য খুব বেশি যে শিক্ষার প্রয়োজন তা কিন্তু নয়। প্রয়োজন হলো ইচ্ছাশক্তি যাতে আপনি নিজেকে সেই স্থানে দেখতে পান যার ইচ্ছা আপনার মধ্যে জ্বলন্ত হয়ে আছে। এটা মনে রাখতে হবে যে যারাই প্রচুর টাকার অধিকারী হয়েছেন তারা প্রথমে স্বপ্ন দেখেছেন এবং সেই স্বপ্নকে সফল করার জন্য যা যা করণীয় তা করেছেন।

Thomas A. Edison এমন একটি ল্যাম্পের স্বপ্ন দেখেছিলেন যা বিদ্যুত সাহায্যে চলবে। দশহাজার বারেরও বেশি বার ব্যর্থ হয়েও তিনি তার স্বপ্ন দেখা বন্ধ করেননি এবং শেষপর্যন্ত সফল হয়েছিলেন।

Wright Brothers এমন একটি যন্ত্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন যা আকাশে উড়বে এবং তাদের সেই ইচ্ছা সেই সময়কার লোকের অসম্ভব মনে হলেও তাঁরা নিজের স্বপ্নকে সার্থক করে তুলেছিলেন।একটি মহান উধৃতি ” স্বপ্ন হল বাস্তবতার চারা। জাগো, জাগো এবং নিজেকে জাহির কর তুমি পৃথিবীর স্বপ্নদর্শী।”

Desire Outwits Mother Nature:

আকাঙ্খা এতটাই শক্তিশালী হতে পারে যে তা মা প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করতে পারে। এবং এটি লেখক নিজের জীবন দিয়ে অনুভব করেছেন। এখানে লেখক তার নিজের ছেলের কাহিনী বিস্তারিত ভাবে বলেছেন যা পড়লে মনে হতে পারে অবিশাস্য কোন রূপকথা।

লেখকের ছেলে ব্লেয়ার যখন জন্মায় তখন তার কান বলে কিছু ছিলোনা। ডাক্তার আশঙ্কা করেছিল যে এই শিশু সারাজীনের জন্য মূক এবং বধীর হতে পারে। কিন্তু একজন পিতা হিসাবে এই কঠিন সত্যটা নেপোলিয়ন হিলের মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল। তিনি মন থেকে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারেননি যে তার সন্তান কোনোদিন শুনতে পাবেনা , সারাজীবন বিকলঙ্গ হয়ে কাটাতে হবে।

তিনি মনে করেন মা প্রকৃতি তার ছেলেকে কান না দিতে পরে কিন্তু শোনার ক্ষমতা কেড়ে নিতে পারেননা। তার ছেলে যাতে আর পাঁচটি স্বাভাবিক ছেলের মত শুনতে পায় সেই ইচ্ছা থেকে তিনি এক সেকেন্ডের জন্য দূরে সরে আসেননি।

লেখক মনে করেন আমাদের সীমাবদ্ধতা আমরা নিজেই তৈরী করি। তিনি চান না তার সন্তান কোনোরকম সীমাবদ্ধতা নিয়ে বড় হয়ে উঠুক। তার জ্বলন্ত ইচ্ছা ছিল যে তার সন্তান যেন স্বাভাবিক ভাবে শুনতে পাই এবং তিনি তার সেই জ্বলন্ত ইচ্ছাকে তার সন্তানের মধ্যে ঢেলে দেন। তার কান না থাকলেও সে বধীর হবে একথা তিনি যেমন নিজেও বিশ্বাস করেননি তেমন তার সন্তানের মধ্যে এই বীজ ঢোকাননি।

সে একটু বড় হলে লেখক তাকে একটি গান শোনার যন্ত্র কিনে দেন। সেটিতে গান চালালে সে উত্তেজিত হয়ে উঠত এবং কিছু অঙ্গ ভঙ্গি করত এই দেখে লেখকের বিশ্বাস আরো বেড়ে যায় যে সে তার স্বাভাবিক শ্রবণ ক্ষমতা একদিন ফিরে পাবে।

এরপর সে যখন বড় হতে থাকে তেমন বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ে কিন্তু লেখক একজন বাবা হিসেবে কোনদিন তার আত্মবিশ্বাস কম হতে দেননি। কোনোদিন তাকে special child হিসেবে সুরক্ষার বেড়াজালে রাখেননি। সাধারণ ছেলেরা যে স্কুলে পড়ে তাকে সেই স্কুলই পাঠিয়েছিলেন। তার নিউজ পেপার বিক্রি করতে চাওয়ার ইচ্ছেকেও প্রশ্রয় দিয়েছেন। সে হাইস্কুলে পড়ার সময় একটি শ্রাবণযন্ত্র ব্যবহার করে কিন্তু তা কোন উপকারে আসেনি। পরে কলেজে পড়ার সময় একটি শ্রাবণযন্ত্র তার হাতে আসে যা তার জীবনটাই পাল্টে দেয়। সে একদম স্বাভাবিক শুনতে পায় ।

অবিশ্বাস মনে হলেও এটাই সত্যি। লেখকের অদম্য ইচ্ছা এবং বিশ্বাস তার ছেলের জীবনে বিস্ময়কর ঘটনা ঘটায়। সে জীবনে প্রথমবার সবারসাথে স্বাভাবিকভাবে কথোপকথন চালাতে পারে। বিশ্বাস এর এতটাই শক্তি যে লেখক নিজের সন্তানের উপর প্রভাব প্রত্যক্ষ করেছেন। এবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে তার সন্তানের সারাজীবন মূক বধীর হয়ে থাকত যদি লেখক ডাক্তারের কথায় আস্থা রেখে হাল ছেড়ে দিতেন।

নিজের প্রতি আস্থা হলো সফল হওয়ার দ্বিতীয় ধাপ :

আস্থা বা বিশ্বাস মনের মধ্যে চলতে থাকা চিন্তাকে সঠিক দিশা দেয়। এখন প্রশ্ন হল নিজের প্রতি এই আস্থা বা বিশ্বাসকে কিভাবে গড়ে তোলা যায় ? বিশ্বাসের অনুভব গড়ে তোলার সহজ উপায় হল নিজের অবচেতন মনকে (subconscious mind) বার বার একই বার্তা পৌঁছানো যতক্ষণ না পর্যন্ত সেই চিন্তা অবচেতন মনের কাছে সহজাত হয়ে যায়। একটি উদাহরণের সাহায্যে ব্যাপারটি সহজে বোধগম্য হবে। একজন অপরাধী যখন প্রথমবার অপরাধ করে তখন সে সেটি করতে ঘৃণাবোধ করে। যদি সে বেশ কিছুদিনের জন্য অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত থাকে তাহলে সে ধীরে ধীরে সেটিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। এবং দীর্ঘদিন ধরে অপরাধ করলে অবচেতন মনের কাছে সেটি স্বাভাবিক বলে মনে হয়। তারপর সে সেই অপরাধের দুনিয়া থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনা।

অর্থাৎ যেকোন চিন্তা – তা সে সদর্থক হোক বা নঙর্থক, যখন বার বার অবচেতন মনে প্রবেশ করে তখন তা সহজাত হয়ে দাঁড়ায়। এবং অবচেতন মন সেই চিন্তাকেই বাস্তবে পরিণত করে। পৃথিবীতে এমন হাজার হাজার মানুষ আছে যারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে দুর্ভাগ্যই তাদের নিয়তি। তারা বিশ্বাস করে যে তাদেরকে সারাজীবন গরিব হয়ে বাঁচতে হবে। লেখক মনে করেন এদের এই ঋণাত্মক চিন্তায় এদের দুর্ভাগ্যের কারণ। তারা যেমন চিন্তা করে এবং যা বিশ্বাস করে তাদের সেই ভাবনাকেই অবচেতন মন বাস্তবে পরিণত করে।

আমাদের অবচেতন মন আমাদেরকে দিয়ে সেইসব কাজই করায় যার নির্দেশ তাকে আমরা চিন্তা (thought) এবং বিশ্বাসের(faith) মাধ্যমে দিয়ে থাকি। তাহলে যদি আমরা তাকে সবসময় সদর্থক চিন্তা পাঠায় তাহলে সেটাও বাস্তবে প্রতিফলিত হবে। লেখক এই প্রক্রিয়াকে auto-suggestion বলে উল্লেখ করেছেন।এই নিয়মটিকে বোঝাতে লেখক একটি সুন্দর পদ্যের উপস্থাপনা করেছেন-

পরাজয়কে মেনে নিলেই তুমি পরাজিত,
মনে যদি সাহস না থাকে, তবে জেতার আশা কোরোনা।
মনে যদি দ্বিধা থাকে তুমি পারবে কিনা
তাহলে মনে রেখো তুমি হেরেই গেছো।

হারবে ভাবলে হার তোমার হবেই,
কারণ সাফল্য থাকে মনের ইচ্ছাশক্তিতে, মনের কাঠামোতে।

যদি ভাব অন্যদের তুলনায় তোমার কাজের মান নীচু,
তাহলে তুমি নিচেই থাকবে।
যদি তুমি ওপরে উঠতে চাও
তাহলে নিজের মনে সংশয় রেখোনা।
কারণ সংশয় থাকলে প্রত্যাশা পূরণ হয়না।

জীবনযুদ্ধে সবসময় বলবান ও দ্রুতগামীরা যেতে না।
যে আত্মবিশ্বাসে অটল
সে আজ হোক, কাল হোক , জিতবেই।