মার্কিন লেখক চার্লস ডুহিগ তার বিখ্যাত বই দ্য পাওয়ার অফ হ্যাবিট এ আলোচনা করেছেন কিভাবে মানব মস্তিস্ক কোনো কাজকে অভ্যাসে পরিণত করে এবং বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার সাহায্যে প্রমান করেছেন যে খারাপ অভ্যাসকে শুধুমাত্র ইচ্ছাশক্তি এবং মনোবলের ওপর ভিত্তি করে মুছে ফেলা যায় না। তারজন্য প্রয়োজন একটি নির্দিষ্ট ফর্মুলা অনুসরণ করা। কি সেই ফর্মুলা তা জানার আগে জেনে নিই কোনো কাজ কখন অভ্যাসে পরিণত হয়।

অভ্যাস কি ভাবে তৈরী হয়?

আমাদের জীবন হল ছোট ছোট অভ্যাসের সমন্বয়। দৈনন্দিন সাধারণ কাজকর্ম যেমন ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করা, খাওয়া, হাঁটা, কথা বলা ইত্যাদি কাজ করতে কোনোরকম চেষ্টা করতে হয় না, নিজের অজান্তেই অভ্যাসগতভাবে এগুলো আমরা করে ফেলি। আমাদের মস্তিস্ক সবসময় শর্টকাট খোঁজে অর্থাৎ কোনোকাজ বার বার করতে হলে কিভাবে কম পরিশ্রমে বা বিনা পরিশ্রমে সেই কাজটা করে ফেলা যায় সেই উপায় খোঁজে। এর ফলে যে শক্তি সঞ্চয় হয় তা মস্তিস্ক অন্য কাজে লাগাতে পারে। তাই বার বার করা আচরণগুলোকে অভ্যাসে পরিণত করে যেন সেটি করতে চিন্তাশক্তির প্রয়োগ না করতে হয়। একজন শিশু যখন প্রথম হাঁটতে শেখে তখন তাকে সচেতন ভাবে অনেক পরিশ্রম করতে হয়, ভারসাম্য রক্ষা করার কায়দা আয়ত্ত করতে হয়। কিন্তু বার বার পরিশ্রম করার ফলে সে হাঁটতে শিখে ফেলে। তাই পরবর্তীকালে হাঁটার সময় তাকে আর ভাবতে হয় না কিভাবে পা ফেলতে হবে। নিজের অজান্তেই অনায়াসে সে কাজটি করে ফেলে।

অন্য একটি উদাহরণ দেখা যাক। প্রথম বাইক চালানো শেখার সময় আমাদের পুরো মস্তিস্ক সেই কাজের দিকে ফোকাস রাখে, ক্লাচ গিয়ার্ ইত্যাদির দিকে খেয়াল রাখার সাথে সাথে ব্যালান্স এবং রাস্তার অন্যান্য যানবাহনের দিকেও মস্তিস্ককে নজর রাখতে হয়। যত বার বার এই কাজটি করা হয় ততই তা অভ্যাসে পরিণত হয়। এরপর আর মস্তিষ্কের প্রয়োগ ছাড়াই আমরা অনায়াসেই অন্য কোনো চিন্তা করতে করতে বা কোন বন্ধুর সাথে কথা বলতে বলতে বাইক চালাতে পারি কারণ কাজটি সচেতন মনে না ঘটে অবচেতন মনে ঘটে।

হ্যাবিট লুপ:

যেকোনো অভ্যাস তৈরী হয় তিনটি ধাপে। ১) প্রথম ধাপ হলো Cue অর্থাৎ এমন কোনো বস্তু, কাজ, সময় বা ঘটনা যা কোনো কাজ করার ক্ষেত্রে ট্রিগার হিসেবে কাজ করে। সেই নির্দিষ্ট cue টির উপস্থিতি ঘটলেই কাজ টি করার জন্য মস্তিস্ক আমাদের উৎসাহিত করে। যেমন কারো কারো অভ্যাস থাকে ভাত খাওয়ার পরেই মিষ্টি খাওয়া। এক্ষত্রে ভাত খাওয়াটা ট্রিগারের কাজ করে যা ব্রেইনকে মিষ্টি খেতে প্ররোচিত করে।

২) এরপর আসে রুটিন। ট্রিগার পাওয়ার পর উক্ত কাজটা সম্পন্ন করার প্রক্রিয়া। ৩) Reward অর্থাৎ কাজটি করার পর যে ভালো অনুভূতি হয় তা ব্রেইনের কাছে পুরস্কারের কাজ করে। এই রিওয়ার্ড পাওয়ার নেশায় ব্রেইন বারবার সেই কাজটি করতে চায়।
যেমন ধরুন, কোনো ধূমপানকারী ব্যক্তি কাজের চাপ বাড়লেই সিগারেট ধরায়। এখানে কাজের চাপ হলো ট্রিগার, সিগারেট খাওয়ার পর্বটা হলো রুটিন এবং সিগরেট খাওয়ার পর যে তাৎক্ষণিক মানসিক শান্তি পাওয়া যায় সেটা হলো রিওয়ার্ড। ট্রিগারকে cravings ও বলা যেতে পারে। যারা নিয়মিত এক্সারসাইজ করে তাদের কাছে এক্সারসাইজ করার পর যে ভালো অনুভূতি হয় সেটা হলো রিওয়ার্ড।

unnamed

মস্তিস্ক অভ্যাস তো বানিয়ে ফেলে নিজের কাজ কমানোর জন্য কিন্তু মুশকিল হলো মস্তিস্ক ভালো অভ্যাস এবং খারাপ অভ্যাসের মধ্যে ফারাক করতে পারে না। সে শুধু সেই কাজকেই অভ্যাসে পরিণত করে যা তাকে বার বার করতে হয়। এখন যদি কোনো ছাত্র প্রতিদিন সকালে উঠে নিয়ম করে পড়তে বসে তাহলে একটা সময় পর এটাই তার অভ্যাসে পরিণত হয়। তারপর সে নিজের অজান্তেই অভ্যাস মতো প্রতিদিন সকালে পড়তে বসে পড়ে। ঠিক তেমনি ভাবেই যদি কোনো ছাত্র প্রতিদিন সকালে উঠে ফেসবুক করে তাহলে তার নিজের অজান্তেই এটি তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। এরপর পরীক্ষার সময় সে পড়তে চাইলেও তার মস্তিস্ক তাকে ফেসবুক করতে প্ররোচিত করে এবং অভ্যাসবশত সে না চাইলেও উক্ত কাজটি করে ফেলে।

খারাপ অভ্যাস থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসবে:

অভ্যাস একদিনে তৈরী হয় না। আবার অভ্যাস একবার তৈরী হয়ে গেলে তাকে পুরোপুরিভাবে ধ্বংস করে ফেলা যায় না। তাকে শুধুমাত্র ভালো অভ্যাস দিয়ে রিপ্লেস বা বদল করা যায়। ট্রিগার এবং রিওয়ার্ড একই রেখে রুটিন পরিবর্তন করে যেকোন খারাপ অভ্যাসকে বদলে ফেলা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ কোন স্মোকার যদি একদিন সিদ্ধান্ত নেয় সে আর স্মোক করবে না তাহলে সেক্ষেত্রে সে চার থেকে পাঁচ দিন সিগারেট থেকে দূরে থাকতে পারলেও নির্দিষ্ট ট্রিগার উপস্থিত হলেই সে আবার পুরোনো অভ্যাসে ফিরে যায়. এক্ষেত্রে ট্রিগার যেকোন কিছু হতে পারে যেমন বন্ধুর সাথে দেখা হওয়া, কাজের চাপ বা মন খারাপ থাকা ইত্যাদি। তাই স্মোক করার ইচ্ছা জাগলেই সিগারেটের বদলে কোন নিকোটিন গাম বা চা, কফি জাতীয় কোনো ক্যাফিন দিয়ে রুটিনটা সম্পন্ন করতে হবে। রুটিন ফলো করলেই রিওয়ার্ড হিসেবে পাওয়া যাবে গুড ফিলিংস। এইভাবে ডুহিগ মনে করেন যেকোনো ভালো অভ্যাস তৈরী করার ক্ষেত্রে ট্রিগার, রুটিন এবং রিওয়ার্ড এইতিনটি ধাপ ঠিকঠাকভাবে অনুসরণ করা জরুরি, তবেই সেই অভ্যাস টি দীর্ঘজীবী হবে।

সফল প্রতিষ্ঠানগুলি অভ্যাসকে কিভাবে কাজে লাগায়:

আমরা শপিং মলে গিয়ে কোন কোন জিনিস কিনব তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের অভ্যাস অনেক দায়ী থাকে। কোম্পানিগুলোর কাছে এতবেশি ডেটা থাকে যে যাত্রা সহজেই আন্দাজ করতে পারে কোন কাস্টমার কি ধরণের জিনিস কিনতে পারে।এই সুযোগ নিয়ে তারা সেইসব জিনিসগুলোর ওপর সেই কাষ্টমারকে ডিসকাউন্ট কুপন পাঠায়। এইভাবে কোম্পানিগুলো কাস্টমারের বিহেভিয়ার হ্যাবিট কে ম্যানিপুলেট করে। যেমন ধরুন, Target নামের এক মার্কিন কোম্পানি কোনো মহিলা কাষ্টমারকে প্রেগনেন্ট হিসেবে আন্দাজ করলে তাকে বেবি ডাইপার সহ অন্যান্য বেবি প্রোডাক্টস এর কুপন পাঠাবে কিন্তু একটু চালাকির সাথে, যাতে করে সেই মহিলা তার ব্যক্তিগত জীবনের ওপর নজরদারি করার জন্য Target কে সন্দেহ না করে। এই চালাকি তাকে বলে সান্ডউইচিং অর্থাৎ বেবি প্রোডাক্টের মাঝখানে যেকোনো অন্য জিনিসের বিজ্ঞাপন।

Keystone habits :

ডুহিগ বলেছেন কিভাবে Alcoa কোম্পানির CEO O’Neill কর্মীদের মধ্যে সেফটি হ্যাবিট গড়ে তোলার ফলে তাদের কর্মক্ষমতা দ্বিগুন বেড়ে গেছে। এক্ষেত্রে ওয়ার্কার সেফটি হল কীস্টোন(keystone) হ্যাবিট। একটি কীস্টোন হ্যাবিট অন্যান্য আরো অভ্যাস গড়ে তুলতে সাহায্য করে। যেমন এক্সারসাইজ একটি keystone হ্যাবিট অর্থাৎ নিয়মিত এক্সারসাইজ করলে স্বাস্থকর খাবার খাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়, জাঙ্ক ফুডের প্রতি আসক্তি কমে, আবার কোন কোন ক্ষেত্রে নেশা করার অভ্যাসও চলে যায়।

সবশেষে বলি দ্য পাওয়ার অফ হ্যাবিট বইটিতে বহু উদাহরণ দিয়ে ডুহিগ মানব মস্তিষ্কের নানাবিধ কর্মকান্ড পরিচালনার কৌশল সম্পর্কে আলোচনা করেছেন এবং অভ্যাসের মতো একটি সুক্ষ বিষয়কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। বহু কোম্পানি মানুষের আচরণগত অভ্যাসকে পর্যবেক্ষণ করে সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে গেছে। আমরাও যদি নিজেদের ছোট ছোট অভ্যাসগুলোকে পরিবর্তন করে নিয়মশৃঙ্খলার মত ভালো অভ্যাস নিজেদের জীবনযাত্রায় নিয়ে আসতে পারি তাহলে সাফল্য আসতে বাধ্য।