হাজার মাইলের যাত্রাও প্রথম পদক্ষেপের মাধ্যমে শুধু হয়- বলে গেছেন চিনা দার্শনিক লাও-জ্য। কিন্তু যখন সেই প্রথম পদক্ষেপ শেয়ার বাজারে প্রবেশের হয় তখন অধিকাংশ মানুষের মনে কিছু ভয় এবং সংশয় কাজ করে। এই ভয় এবং সংশয় জন্মায় কিছু ভুল ধারণা থেকে। আজ আলোচনা করব সেই রকমই কিছু ভুল ধারণা সম্পর্কে যা থেকে আপনি যত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসবেন, আপনার বিনিয়োগের পথ তত সুগম হবে।
১) শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ মানেই জুয়া খেলাঃ
শেয়ার বাজারে টাকা ঢেলে রাতারাতি বড়লোক হয়ে গেছে বা রাতারাতি পথে বসেছে, এই ধরনের বিক্ষিত ঘটনা আমরা সবাই কখনও না কখনও শুনে থাকব। এই সমস্ত ব্যতিক্রমী খবরই আমাদের মধ্যে এই ভ্রান্ত ধারণার জন্ম দেয় যে শেয়ার বাজার হল জুয়া খেলার সমার্থক। কিন্তু আসল ব্যাপারটা হল শেয়ার বাজার ব্যবসার সমতূল্য। ব্যবসাতে যেমন টাকা খাটালে মুনাফা হয়, তেমনি কোন ভালো কোম্পানীতে টাকা বিনিয়োগ করে আপনার পুঁজি বাড়ানো সম্ভব। যেকোন ব্যবসার সঙ্গে ঝুঁকি যেমন জড়িয়ে থাকে তেমন শেয়ার বাজার ও ঝুঁকিপূর্ণ। ব্যবসার মত লাভক্ষতি দুটোই আছে শেয়ারবাজারে। তবে এটিকে জুয়া খেলার মত দেখলে হবে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শেয়ারবাজারে টাকা বিনিয়োগ করে যারা স্বল্প সময়ের মধ্যে বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা টাকা হারান।
২) শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করা কঠিন:
অনেকেরই ধারণা থাকে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করা কঠিন। কিন্তু আসলে তা নয়। আপনার কাছে যদি android মোবাইল থাকে এবং তাতে internet সংযোগ থাকে তাহলে আপনি নিজেও ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট (de materialized account), ট্রেডিং অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন আপনার জরুরী ডকুমেন্টস্ দিয়ে। ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট হলো সেই অ্যাকাউন্ট সেটা ছাড়া শেয়ার বাজারে ট্রেড করা যায় না। ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট এ আপনার কেনা শেয়ার এবং অন্যান্য financial Securities (যেমন মিউচ্যুয়াল ফান্ড, সরকারী বন্ড, গোল্ড বন্ড ইত্যাদি) ইলেকট্রনিক ফরম্যাটে স্টোর করে রাখা হয়।
UPSTOCKS, ANGELONE, ZERODHA, GROWW ইত্যাদি হল কিছু online ব্রোকার যারা ভারতের দুটি সব থেকে বড় stock exchange (Bombay Stock Exchange National Stock erchange) এর সদস্য। আপনি যেকোন একটি online Platform এ (যেমন আধার কার্ড, প্যান কার্ড, ব্যাংক ডিটেইলস ইত্যাদী) দিয়ে নিজের ডি ম্যাট অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন।
যদি online পদ্ধতিতে আপনি সচ্ছন্দ বোধ না করেন তাহলে আপনার নিকটবর্তী বিশ্বস্ত কোন ব্রোকারের অফিসে গিয়েও আপনি account খুলতে পারেন। তবে অনলাইন বা অফলাইন যেখানেই করুন সেই ব্রোকার সম্পর্কে বিস্তারিত বাচাই করে তবেই করবেন।
একবার ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট খুলে ফেললেই দেখবেন বিনিয়োগ করাটা আর জটিল মনে হবে না। আপনি নিজে নিজেই কোন কোম্পানীর স্টকের কত দাম কত তা বিচার করতে পারবেন এবং আপনার সুবিধা মত কম দামে শেয়ার কিনে বেশি দাম হলে বিক্রি করতে পারবেন। আপনার ডি ম্যাট অ্যাকাউন্টের সঙ্গে যে ব্যাঙ্ক লিঙ্ক থাকবে সেখানে আপনার টাকা ট্রান্সফার হয়ে যাবে।
৩) শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন :
শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন- এই ভুল ধারণা প্রায়শই আমরা অনেকেই করে থাকি। NSE( National stock exchange) এং BSE (Bombay stock exchange) তে অন্তর্ভুক্ত কোম্পনীগুলির মধ্যে কিছু কোম্পানীর স্টক মূল্য যেমন দশটাকার নীচে আছে তেমনি ৭৪ হাজার টাকার ও (MRE Limited) আছে। দীর্ঘসময়ের জন্য বিনিয়োগ করতে চাইলে ভালো কোম্পানীর (দুটি বা তিনটি) শেয়ার প্রথম অবস্থায় কিনতে পারেন এবং সেগুলোর দাম মাঝেমধ্যে track করতে পারেন যখন চলতি দামের থেকে ৩%-৫% দাম কমবে তখন অল্প অল্প করে শেয়ার আপনার পোর্টফোলিওতে যোগ করতে পারেন। তবে কমদামের যে সে কোম্পানীর শেয়ারের অনেকগুলো ইউনিট কেনার থেকে বুনিয়াদী ভাবে মজবুত (fundamentally strong) কোম্পানীর শেয়ারহোল্ডার হওয়া অনেক বেশী বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ ভালো কোম্পানীর শেয়ার যদি আপনার কেনা থাকে তাহলে যদি শেয়ার মার্কেটে কখনও ধ্বস নামে তাহলে সাময়িক ভাবে আপনার কেনা শেয়ারের মূল্য কমে গেলেও আপনার ভয় করার দরকার পড়বে না কারণ আপনি জানেন long-term এ এই কোম্পানি ভালো মুনাফা দেবে ।
৪) স্টক মার্কেট শুধুমাত্র বিশেষজ্ঞদের জন্যঃ
অনেকেরই ভুল ধারনা থাকে শেয়ার মার্কেট সাধারণ মানুষের জন্য নয়। যারা accountancy নিয়ে পড়াশোনা করেছে বা যারা এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তারাই একমাত্র এখানে বিনিয়োগ করে মুনাফা করতে পারে। কিন্তু সত্যিটা হল শেয়ার বাজারে ট্রেডিং শুরু করতে কিছু বেসিক জ্ঞান থাকাই যথেষ্ট। পুঁথিগত বিদ্যার তুলনায় যেকোন কাজ হাতেকলমে করলে সেই কাজে দক্ষ হওয়ার সম্ভবনা যেমন বেড়ে যায় ঠিক তেমনই শেয়ার বাজার সম্পর্কে সাধারণ কিছু জ্ঞান(তা সে পেপার পড়েই হোক বা ইন্টারনেটের মাধ্যমেই হোক) লাভ করার পর আপনার আসল অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হবে যখন আপনি হাতে কলমে কী স্টক কেনা বেচা শুরু করবেন। কিছু সময়, শেখার আগ্রহ এবং নিয়মানুবর্তিতা (discipline) আপনাকে একজন দক্ষ বিনিয়োগকারী বানাতে পারে। প্রথমে আপনি হয়ত কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তবে সময়ের সাথে সাথে আপনার ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা অনুযায়ী উচ্চ মানের সঠিক স্টক বাছতে সক্ষম হবেন।
৫) বেশী ঝুঁকি মানেই বেশী লাভ :
শেয়ার বাজার সদা পরিবর্তনশীল। সোম থেকে শুক্র, সপ্তাহে পাঁচদিন সকাল ৯.৩০ থেকে বিকেল ৩.৩০ পর্যন্ত শেয়ার বাজারে কেনা বেচা করা যায় অর্থাৎ বাজার খোলা থাকে। প্রতিদিন শেয়ারের দাম ওঠানামা করে। তাই অনেকের মনে হতে পারে বেশি ঝুঁকি নিতে পারলেই বেশী লাভ হবে এবং এই ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে অনেক মানুষের টাকা ডুবে যায়।
বেশী ঝুঁকি নিতে পারলে বেশী লাভ হওয়ার হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। আপনার লাভ লোকসান নির্ভর করবে আপনি কোন ধরণের কোম্পানীতে বিনিয়োগ করছেন, সেই কোম্পানী তিনবছর বা পাঁচবার পর কেমন Performance দেবে তার ওপর। মার্কেট কোনদিকে যাচ্ছে তার সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকলে বেশী ঝুঁকি না নেওয়ায় শ্রেয়। লোভ মানুষকে পথে বসায়। কোন কোম্পানী বিগত ১ বছরে ২00% বা 800% Return দিয়েছে তার মানে তো এটার কোন গ্যারান্টি নেই যে ভবিষ্যতেও সেই কোম্পানী এই Performance চালিয়ে যাবে। এটা মনে রাখতে হবে যে, কোম্পানীর অতীতের বা বর্তমানের performance, তার ভবিষ্যতের Performance এর মাপকাঠি নয়। তাই ধৈর্য্য, রিসার্চ এবং calculated risk আপনাকেএকজন better investor বানাতে পারে। কোন দুর্বল কোম্পানীর আকর্ষণীয় ফাঁদে পা না দিয়ে পরিকল্পনামাফিক ঝুঁকি নিতে হবে।
আশা করি, শেয়ার বাজার সম্পর্কে এর মধ্যে কোন ভুল ধারণা যদি আপনার থেকে থাকে তা দূর করতে পেরেছি। সজাগ থাকুন এবং ভূল ধারণাগুলি মন থেকে মুছ ফেলে বিনিয়োগ শুরু করুন।