সালটা ছিলো ২০০৭ আমাজানের মতো একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকুরীরত দুই যুবক ঠিক করলো চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেদের একটি কোম্পানি খুলবে। আমাদের মতো ছা পোষা বাঙালিদের কাছে হয়তো কাজ টা বোকামো মনে হতে পারে কিন্তু নতুন কিছু করতে গেলে ঝুঁকি তো নিতেই হবে! তাই মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে ই কমার্সের মতো একটি অনিশ্চিত ব্যবসার দুনিয়ায় প্রবেশ করলো সচিন বানসাল এবং বিনি বানসাল।
সচিন বানসাল এবং বিনি বানসাল দুজনেরই জন্ম চন্ডিগড়ে হলেও দিল্লির IIT থেকে নিজেদের ইঞ্জিনিয়ারিং এর পড়াশুনা সম্পূর্ণ করেন। ২০০৫ সালে যখন দুজনেই আলাদা আলাদা শিক্ষাবর্ষে বি টেক করছিলেন তখন ঘটনাচক্রে একই ল্যাবে তাদের পরিচয় ঘটে। বন্ধুত্বের সূত্রপাত হয়। স্নাতক ডিগ্রি লাভ করার পর কর্মসূত্রে দুজনেই ব্যাঙ্গালোরে পাড়ি দেন। সেই সময় সচিন Techspan নামে একটি কর্পোরেশনে এবং বিনি Sarnoff এ কাজ করছিলেন। ২০০৬ সালে সচিন Amazon কোম্পানিতে কাজ করতে শুরু করে। ২০০৭ এ ওই কোম্পানিতে যোগ দেয় বিনি।
ফ্লিপকার্ট এর জন্ম : সময়টা তখন যখন আমাজন ভারতীয় বাজারে প্রবেশ করেনি। আমাজনে কাজ করতে করতে সচিন বানসাল এবং বিনি বানসাল ভারতীয় বাজারে ই কমার্সের সুপ্ত অথচ শক্তিশালী সম্ভবনা অনুভব করে। সে সময় ভারতে কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ছোট ছোট ই কমার্স ওয়েবসাইট ছিল। কিন্তু অনলাইনে জিনিসপত্র কেনার ভালো অভিজ্ঞতা ভারতীয় ক্রেতার ছিল না। তাই তারা এমন একটি ওয়েবসাইট তৈরী করার কথা ভাবলো যেখানে ক্রেতা কোন জিনিসের দাম কোন প্লাটফর্মে কত তা তুলনা করতে পারে।
এই আইডিয়াকে বাস্তবায়িত করতে তারা তখন যে সব ভারতীয় শপিং ওয়েবসাইট ইন্টারনেটে উপলব্ধ ছিল সেগুলোকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। কিন্তু সেগুলোর পরিষেবা এটি দুর্বল ছিল যে তারা এই তুলনাকারী ওয়েবসাইট গড়ে তোলার আগ্রহ হারিয়ে ফেললো। তখন তারা ভাবলো এমন একটি অনলাইন শপিং সাইট তৈরী করতে কেমন হয় যা ভারতীয় ক্রেতাদের মনে না দেখে না ছুঁয়ে জিনিস কেনার ভয়ভীতি দূর করবে এবং উন্নতমানের গ্রাহক পরিষেবা প্রদান করবে।
সে সময় ভারতে মাত্র ৫ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করতো। কিন্তু সচিন বানসাল ছিল বিচক্ষণ এবং দূরদর্শী। তাই সহজেই বুঝতে পেরে গিয়েছিলো আগামী দিনে নতুন নতুন ভারতীয় ইন্টারনেট পরিষেবার সাথে যুক্ত হবে। তাই মানুষের অনলাইন শপিং অভিজ্ঞতাকে আমূল বদলে দিতে তারা আমাজনের চাকরি ছেড়ে দিয়ে মাত্র চার লক্ষ টাকা নিয়ে শুরু করে ফেললো নিজেদের ইকমার্স কোম্পানি ফ্লিপকার্ট। সময়টা ছিল ২০০৭ এর সেপ্টেম্বর। তাদের প্রথম অফিস হল ব্যাঙ্গালোরের একটি দুই কামরাযুক্ত আপার্টমেন্ট। প্রথমে তারা অনলাইনে বই বিক্রি করার কথা ভাবলো। কারণ একদিকে পুঁজি কম অন্যদিকে বইয়ের লিস্টিং এবং বই বিক্রেতা পাওয়া সহজ।
কিন্তু যতটা সহজ তারা মনে করেছিল ব্যাপারটা ততটা সহজ ছিল না। বই বিক্রেতারা অনলাইনের মতো একটি অনিশ্চিত প্ল্যাটফর্মে বই বিক্রি করতে রাজি হয়নি। সেসময় মানুষ না দেখে না ছুঁয়ে আগে থেকে পেমেন্ট করে জিনিস কেনার ব্যাপারে ভীষণ রকম সন্দেহবাতিক ছিল ফলে তাদের ওপর বিশ্বাস করে কোনো বিক্রেতা এগিয়ে আসতে চায়নি। কিন্তু তারা সহজে হার মানার পাত্র নয়। বহু কষ্টে কয়েকজন বই বিক্রেতা কে রাজি করিয়ে ২০০৭ এর অক্টবরে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের ওয়েবসাইট লঞ্চ করে।
ওই মাসেরই শেষের দিকে ভিভিকে চন্দ্র নাম একজন যুবকের কাছ থেকে তারা তাদের প্রথম বইয়ের অর্ডার পায়। এই মুহূর্তটা ছিল তাদের কাছে বিশ্বজয়ের মতো ব্যাপার। আশার মধ্যেও নিরাশা দেখা দেয় যখন তারা লক্ষ্য করে যে বইয়ের অর্ডার এসেছে তা কোনো বই বিক্রেতার কাছে নেই। কিন্তু গ্রাহকের বিশ্বাসকে টলতে দিলে চলে না তাই গোটা ব্যাঙ্গালোরে খুঁজে সে বই জোগাড় করা হয় এবং গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। এইভাবে দুজন যুবকের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় শুরু হলো এমন একটি ব্যবসা যা অনলাইন কেনাকাটায় আমূল পরিবর্তন এনে দিল। ছমাসের মধ্যেই কোম্পানি লাভের মুখ দেখল। চার লক্ষ টাকা নিয়ে শুরু করে মাত্র দু বছরের মাথায় ফ্লিপকার্ট চার কোটি টাকার বই বিক্রি করে ফেললো যা এককথায় অভাবনীয়।
বইপ্রেমীদের কাছে ফ্লিপকার্ট একটি বিশ্বাসের জায়গা হয়ে উঠলো এবং ধীরে ধীরে বিনিয়োগকারীদের নজরে আসতে লাগলো। ২০০৯ এ Accel নামক একটি সংস্থা এক মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে রাজি হয়ে গেলো। এরপর ২০১০ সালে দশ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে Tiger Global তাদের সঙ্গে যুক্ত হলো। নতুন পার্টনার এবং আরো বেশি পুঁজি নিয়ে ফ্লিপকার্ট তাদের সাইট এ ইলেক্ট্রনিক্স বিভাগ চালু করলো হল। বই এর সঙ্গে নতুন সংযোজন হল মোবাইল। কিন্তু মানুষ না দেখে না ছুঁয়ে মোবাইলের মত দামি জিনিস অনলাইনে কেনার ভরসা পেলো না।
ভারতীয় গ্রাহকের এই দ্বিধাকে আঁচ করতে পেরে ক্যাশ অন ডেলিভারি ব্যবস্থা চালু করলো। জিনিস হাতে পেয়ে টাকা দিতে মানুষ অনেক সাচ্ছন্দ বোধ করলো। এরপর ফ্লিপকার্ট ববাজারে নিয়ে এলো সহজ রিটার্ন পলিসি এবং রিপ্লেসমেন্ট পলিসি। ক্রেতাদেরকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে প্রাথমিক ভাবে লাভ কিছুটা কমলেও এই তিনটি পলিসির জন্য বিক্রি কয়েকগুন পরিমান বেড়ে যায়। ২০১১ সালে তাদের লভ্যাংশ চার কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৭৫ কোটি। ভারতে অনলাইন শপিং যদিও জনপ্রিয় ছিল না তবু ফ্লিপকার্ট ২৪x৭ কাস্টমার পরিষেবা দিয়ে ব্র্যান্ডের প্রতি মানুষের আস্থা এবং ভালোবাসা দুটোই গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল।
পাঁচ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম আর ধৈর্যের ফলে ২০১২ সালে ফ্লিপকার্ট ভারতীয় বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে ফেললো। কিন্তু ২০১৩ সালে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ভারতীয় বাজারে ঢুকে পড়লো আমাজন। কম্পিটিশন থাকলে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসবে এটাই স্বাভাবিক। বাজারে টিকে থাকতে শপিং সাইট এ নতুন নতুন বিভাগ সংযোজিত হতে থাকলো। বর্তমানে ইলেক্ট্রনিক্স, দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র, ফ্যাশন, গ্রোসারি সহ আশিটি বিভাগের অন্তর্গত ১৫০ মিলিয়ন জিনিসপত্র পাওয়া যায় ফ্লিপকার্টে।
২০১২ সালে ফ্লিপকার্ট নিজেদের অনলাইন ডিআরএম-ফ্রি মিউজিক স্টোর Flyte লঞ্চ করে কিন্তু বাজারের প্রতিযোগিতার সঙ্গে পাল্লা দিতে না পারায় ২০১৩ সালে তা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২০১৪ সালে ২৮০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে Myntra নামক একটি অনলাইন ফ্যাশন ওয়েবসাইট কেনে। এছাড়াও ২০১৬ সালে ৭০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে আর একটি ফ্যাশন ওয়েবসাইট Jabong কে কিনে নেয়। এই দুটি ডিল তাদের ব্যবসায় অনেকখানি সমৃদ্ধি এনে দিয়েছিলো।
eBay, PhonePe , Ekart এই কোম্পানিগুলোকেও তারা কিনে নেয়। ফলে ফ্লিপকার্টের মার্কেট শেয়ার ৩১.৯% থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৮.৩% সচিন বানসাল এবং বিনি বানসাল এর পার্টনারশিপ শেষ হয় যখন ২০১৮ সালে মার্কিন রিটেইলার কোম্পানি ১৬ বিলিয়ন ডলার দিয়ে ফ্লিপকার্টের ৭৭% শেয়ার কিনে নেয়। সচিন বানসাল তার শেয়ার বিক্রি করে কোম্পানি ত্যাগ করে। আজ ফ্লিপকার্টের মালিক কোনো ভারতীয় নয় কিন্তু সচিন বানসাল এবং বিনি বানসাল এর জুটি এক অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছে। সচিন স্বপ্ন দেখতো বিনি তা বাস্তবের রূপ দিতো। তাদের সাফল্য আগামী দিনে নতুন উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করবে।