আদানি গ্রুপ হল ভারতের একটি বহুজাতিক সংস্থা যার প্রতিষ্ঠাতা এবং বর্তমান কর্মকর্তা হলেন গৌতম আদানি। গৌতম আদানি গুজরাটের একটি ছোট শহর আহমেদাবাদ থেকে তার ব্যবসা
( মূলত পণ্যসামগ্রীর) শুরু করে আজ বিশ্বসেরা ধনী উদ্যোক্তাদের মধ্যে ১৩ তম স্থান অধিকার করে আছেন। ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী তিনি হলেন এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ধনী ব্যাক্তি । আমেরিকান বিজনেস ম্যাগাজিন Forbes এর হিসাব অনুযায়ী ৭ ই জুন পর্যন্ত তাঁর পারিবারিক সম্পত্তি ৭৭.৭ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার। বর্তমানে এই সংস্থার কর্মচারি সংখ্যা ১৭ হাজারের উর্ধ্বে।

গৌতম আদনির ১৯৬২ সালের ২৪ শে জুন আমেদাবাদ এর একটি জৈন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শান্তিলাল আদানি একজন বস্ত্রব্যবসায়ী ছিলেন। গৌতম আদানি গুজরাট ইউনিভার্সিটিতে কমার্স নিয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রিতে ভর্তি হলেও পড়াশোনায় আগ্রহী ছিলেন না। দ্বিতীয় বছরেই কলেজ ছেড়ে দেন এবং ১৯৭৮ সালে মুম্বাই পাড়ি দেন। মুম্বাই এ মহেন্দ্র ব্রাদার্স এ একজন হীরে বাছাইকারি হিসেবে নিজের কর্মজীবনের সূচনা করেন। সেখানে  দুতিন বছর কাজ করার পর মুম্বাই এর জাভেরি বাজারে নিজের ডায়মন্ড ব্রোকারেজ ফার্ম প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৮১ সালে তাঁর বড় ভাই মুনসুকভাই আদানি আমেদাবাদ এ একটি প্লাস্টিক কারখানা কেনেন এবং সেটি ঠিক মত পরিচালনা করার জন্য গৌতম আদনিকে মুম্বাই থেকে ডেকে পাঠান। এইভাবে তার জীবনে এল নতুন একটি মোড় ।

গৌতম আদানি লক্ষ্য করলেন প্লাস্টিক তৈরির প্রধান উপাদান পলিভিনাইল ক্লোরাইড (পিভিসি) সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের অভাব। যে সব ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে আছে তা যথেষ্ট না মনে হওয়ায় তিনি এটি বিদেশ থেকে আমদানি করা শুরু করলেন। এইভাবে বিশ্ব বাজারের সঙ্গে পরিচয় ঘটলো গৌতম আদানির। ১৯৮৮ সালে স্থাপন করেন আদানি এক্সপোর্টস যা মূলত পণ্যসামগ্রী আমদানি রফতানির কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল। পরবর্তীকালে আদানি এক্সপোর্টস এর নামকরণ হয় আদানি এন্টারপ্রাইজেস্ যা আদানি গ্রুপের প্রধান কোম্পানি। আদানি এন্টারপ্রাইজেস্ প্রধানত চাষবাস এবং বিদুৎ সংক্রান্ত পণ্যের বিপণনের সঙ্গে যুক্ত ছিল।  ১৯৯১ সালে অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতি চালু হলে কোম্পানি খনিজ পদার্থ, বস্ত্রশিল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে তার ব্যবসার প্রসার ঘটায়।

১৯৯৪ সালে গুজরাট সরকার মুন্দ্রা বন্দর  পরিচালনার জন্য বেসরকারি কোনো কোম্পানি খুঁজছিল। ১৯৯৫ সালে মূন্দ্রা বন্দর পরিচালনার চুক্তি পায় আদানি। বর্তমানে মুদ্রা পোর্ট হল ভারতের প্রথম বৃহত্তম প্রাইভেট সেক্টর পোর্ট যা বাৎসরিক ২১০ মিলিয়ন টন কার্গো ধারণ ক্ষমতা রাখে।

আদানি এন্টারপ্রাইজেস্: এটি হল আদানি গ্রুপের মূল কোম্পানি যা মাইনিং, রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, ডিফেন্স এবং এরোস্পেস ইত্যাদি ক্ষেত্রে নিজের ব্যবসা কে বিভক্ত করে রেখেছে।  ।এই কোম্পানি অন্যান্য কোম্পানির ইনকিউবেটর হিসেবে কাজ করে অর্থাৎ অন্যান্য শাখা কোম্পানি গুলোকে মূলধন সরবরাহ করে। এর শাখা কোম্পানি গুলো হল :

আদানি উইলমার: ১৯৯৯ সালে আদানি গ্রুপ  Wilmar International এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে শুরু করে আদানি উইলমার নামে একটি খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প। ফরচুন ব্র্যান্ডের খাবার তেল, আটা, চাল, ডাল, সয়া বড়ি ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুতকারক হলো আদানি উইলমার গোষ্ঠী। এছাড়াও alife ব্র্যান্ড নামে প্রসাধনী সামগ্রী যেমন সাবান, হ্যান্ডওয়াশ ইত্যাদি এখানে উৎপাদন করা হয়।

আদানি এয়ারপোর্ট হোল্ডিংস: এটি বিমান বন্দর পরিচালনার যাবতীয় কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত। এটি মুম্বাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট লিমিটেড এর প্রধান অর্থ সরবরাহকারী সংস্থা। এছাড়াও ২০২১ এর জানুয়ারি থেকে আহমেদাবাদ, গুয়াহাটি, জয়পুর, লক্ষ্ণৌ, মাঙ্গালোর, তিরুবনন্তপূরম ইত্যাদি ছয়টি শহরে বিমানবন্দর নির্মাণ ও পরিচালনার জন্যে ৫০ বছরের লিজ নিয়েছে এই সংস্থা।

আদানি পাওয়ার: এটি ১৯৯৬ সালের আগস্টে প্রতিষ্ঠিত। এটি ভারতের বিভিন্ন ধরনের পাওয়ার প্রজেক্ট পরিচালনার চুক্তি নেয়। এটির অন্তর্গত চারটি তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, দাহেজ ও মুন্দ্রা তে অবস্থিত যা মিলিতভাবে ১০,৪৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। ২০১৪ সালে আদানি পাওয়ার টাটা পাওয়ার কে টপকে ভারতের সর্ববৃহৎ তাপ বিদ্যুৎ উৎপাদকের স্বীকৃতি পায়। ভারতের বাইরেও আদানি পাওয়ার ( ওভারসিজ) লিমিটেড তার কাজকর্ম চালায়।

আদানি গ্রীন এনার্জি: এটি  ১৯১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংস্থা বিভিন্ন ধরনের অপ্রচলিত শক্তি যেমন বায়ুশক্তি, সৌর শক্তি ও ইত্যাদি উৎপাদনের কাজ করে। বর্তমানে ১১ টি রাজ্যে ৪৬ টি প্রকল্প সহ ৫,২৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ( বায়ু ও সৌর শক্তি) উৎপাদনের প্ল্যান্ট পরিচালনা করে। ২০২০ সালে মে মাসে আদানি গ্রীন এনার্জি লিমিটেড (AGEL) বিশ্বের সবচেয়ে বড় সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট (৮০০০ মেগাওয়াট)  তৈরির চুক্তি পায়।২০১৯ সালের শেষের দিকে AJEL বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে ৩৬২.৫ মিলিয়ন ডলার এর গ্রীন বন্ড চালু করে যা এর আগে কোনো ভারতীয় কোম্পানি করেনি।

আদানি পোর্ট অ্যান্ড সেজ: ২০১৬ এর এপ্রিলে এর জন্ম। SEZ কথার অর্থ হল স্পেশাল ইকোনমিক জোন অর্থাৎ ভৌগলিক ভাবে নির্দিষ্ট একটি এলাকা যার ম্যানেজমেন্ট এবং কাস্টমস্ এর নিয়মকানুন স্বতন্ত্র। এটি হলো ভারতের বৃহত্তম প্রাইভেট পোর্ট কোম্পানি যার বর্তমান কর্মকর্তা হলেন করন আদানি। এটি যে সমস্ত বন্দরের কার্যক্রম পরিচালনা করে সেগুলো হল মুন্দ্রা পোর্ট, দহেজ পোর্ট, হাজিরা পোর্ট, ধামরা পোর্ট, কাত্তুপল্লি পোর্ট, ভাইজাগ, টার্মিনাল, মর্মুগাও টার্মিনাল এবং এনোর টার্মিনাল।

আদানি টোটাল গ্যাস: এটি একটি গ্যাস সরবরাহকারী সংস্থা যা আদানি গ্রুপ এবং ফরাসি তেল ও গ্যাস কোম্পানি টোটাল(SE) এর যৌথ উদ্যোগে গঠিত হয়েছে। ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ভারতের ২২ টি ভৌগলিক এলাকায় পাইপের মাধ্যমে গ্যাস বিতরণের কাজ করেছে। এছাড়াও ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশনের সাথে যৌথ উদ্যোগে এই কোম্পানি ১৯ টি শহরে গ্যাস বিতরণ কেন্দ্র গড়ে তুলেছে।

আদানি রোড ট্রান্সপোর্ট: এই সংস্থা হাইওয়ে, এক্সপ্রেসওয়ে এবং টোল ওয়ে নির্মাণের কনট্র্যাক্ট নেয়। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশার দুটি জাতীয় সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের জন্য National highway authority of India এর পক্ষ থেকে লেটার অফ অ্যাওয়ার্ড পেল এই সংস্থা।

ব্যবসার পাশাপাশি আদানি গ্রুপ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কাজকর্মের সাথে যুক্ত। আদানি ফাউন্ডেশন ১৯৯৬ সালে গঠিত হয় যার মাধ্যমে আদানি গ্রুপের মূল প্রফিটের দুই শতাংশ খরচ করা হয় বিভিন্ন ধরনের জনহিতৈষী মূলক কাজ কর্মে। উড়ান, সুপোশান, স্বচ্ছগ্রহ, সক্ষম ইত্যাদি হলো এই প্রতিষ্ঠানের কয়েকটি সেবামূলক প্রকল্প। পরিবেশ সংরক্ষন ও জল সংরক্ষন কার্যেও এই সংস্থা হাত লাগিয়েছে।